আপডেট প্রতিদিন, বেবি চক্রবর্ত্তী:-ভারত একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে বর্তমান অতীতের সাথে জড়িত জাতীয়তাবাদ। অখন্ড ভারতের উত্তরে ছিল তিব্বত, নেপাল ভুটান, দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা, পূর্বে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ( ব্রম্ভ্রদেশ) পশ্চিমে পাকিস্তান, আফগানিস্তান । , “এটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে ভারতের ভাবমূর্তি একেবারেই উজ্জ্বল হবে না। চারপাশে যতগুলো রাষ্ট্র আছে, প্রত্যেকের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে ভারত। এখন যদি অখণ্ড ভারতের মানচিত্র সংসদ ভবনে রাখা হয়, তার ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা কতটা?”“১৯৪৭ সালে ঐতিহাসিকভাবে আমরা যে ভূখণ্ড পেয়েছি, ভারতবর্ষ সেই ভূখণ্ডের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিকগত ভাবে দেশের সীমানা নির্ধারণ করা আবার সেখানে নিজস্ব সেনা মোতায়েন করা ২৪ ঘন্টা। ফলে অখন্ড ভারতের অলীক স্বপ্ন বর্তমান। এর দর্শন, এর ধারণা অনেক গভীর। দেশ পরিচালিত হয় সংবিধান মেনে, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ মেনে। তাই এধরনের পদক্ষেপ প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে অবনতি হবে । বর্তমানে অখন্ড ভারতের কল্পনা অবাস্তব।শহরের চারিদিকে জাতীয় পতাকা সাথে দেশভক্তি সঙ্গীত বন্দেমাতরম্ – বন্দেমাতরম্ – ১৫ ই অগষ্টের স্বাধীনতা সুর প্রতিধ্বনি দেশপ্রেমী শত শত বিপ্লবীদের রক্তে যে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা আচমকা ঝড়ের মত ভেঙে পড়ে, ১৯৪৭ সালে ১৫ ই আগষ্ট মধ্য রাতের অন্ধকারে স্বাধীনতা ঘোষণার পর ব্রিটিশ ভারতকে দীর্ঘদিনের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের পর ১৯৪৭ এর ১৫ ই আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ভারত (India) – পাকিস্তান (Pakistan )নামে দুটি স্বীধীন অধিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয় | সারা দেশ যখন মুক্তির আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে , তখন দেশে একটি নতুন শ্লোগান ওঠে ——— “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় | ভুলো মাৎ ভুলো মাৎ “——” এই স্বাধীনতা মিথ্যা, ভুলো না, ভুলো না |” বলা বহুল্য, এ অভিযোগ যথার্থ নয় , বরং বলা য়ায় —- অর্ধ – সত্য | ড. অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন, “এ আজাদি একেবারে ঝুটা না হলেও জন্মসূত্রে প্রতিবন্ধী |”

আসলে স্বাধীনতা লাভের ফলে ভারত দু- টুকরো হয়ে যায়| ভারতের দুটি সমৃদ্ধিশালী প্রদেশ —- বাংলা ও পাঞ্জাব দ্বিখন্ডিত হয়| দেশজুড়ে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, লুন্ঠন,নারীনির্যাতন, ধর্মান্তর এবং লাখ লাখ ছিন্নমূল মানুষের দেশান্তর গমন|ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ায় পাকিস্তান ভারত – ভুক্ত পাঞ্জাব থেকে লাখ লাখ মানুষ ভারতে চলে আসতে থাকে| এইসব দেশত্যাগী মানুষদের জন্য বাসস্থান, খাদ্য ও কাজের ব্যাবস্থা কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়| দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিও বিভক্ত হয়ে যায়| ভারতে দেখা যায় চরম বেকার সমস্যা| ১৯৪৭ এর অখন্ড ভারত ভাগ নতুন দেশের গৃহহীন ও বাস্তুুচ্যুত | ১৯৪৭ সালের এপ্রিলেও বোঝা যায়নি আগষ্টে দেশভাগ হবে| এপারের মানুষ ওপারে যাবে | ওপারে মানুষ এপারে | মুর্শিদাবাদ, খুলনাার মানুষ বিভ্রান্ত হবে তাদের অংশে ভারত না পাকিস্তানের পতাকা উড়বে | সিলেটের করিমগঞ্জে পাকিস্তানের পতাকা উড়েও নেমে যাবে| পাক্তন এক ইংরেজ বিচারক স্যার সেরিল রার্ডক্লিফ যিনি আগে কোনদিন ভারতবর্ষে আসেনি, ভালো করে ম্যাপ পড়ার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা ( Cartographic Knowledge ) যার নেই, প্রত্যখ্য কোনো অভিজ্ঞতা নেই এ অঞ্চলের মানুষের জীবন সংস্কৃতি,ভাষা ও আনন্দ – বেদনার তাকে কিনা দায়িত্ব দেওয়া হল বাংলাকে বিভক্ত করার বাউন্ডারি কমিশনের | স্যার লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন দেশভাগের জন্য তাড়াতাড়ি করে ধরে এনেছিল তখনকার রাজনৈতিক চাপের পরিস্থিতি সামাল দিতে, তার আঁকিবুকি ও নানা কূটকৈশলের রাজনৈতিক সমীকরণে কোটি কোটি মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা আর বিপর্যয় নেমে আসবে | অনেকের নতুন পরিচয় হবে উদ্বাস্তুু | ছেড়ে যেতে হবে সাতপুরুষের বসতি, স্মৃতি ও সংগ্রামের ভূমি, নদী -মাঠ- ঘাট, আশৈশব, হেঁটে যাওয়া চেনা পথ , প্রান্তর | পেছনে পড়ে থাকবে ধু-ধু স্মৃতির ভূমি, স্বজনের কবর আর শশ্মান| অসহায় অজস্র মানুষের স্থান হবে রিফিউজি ক্যাম্প | কেউ যাবে দূর পৌরাণিক কাহিনীর অনুর্বর দেশ -দন্ডকারণে| তাদের সংগ্রাম ও গভীর বেদনা ফুরাবে না একজীবনে | আজ যেন সব স্মৃতির পাতা…| স্বাধীনতার একশো বছর ও এখনো হয়নি। দেশ চলবে সংবিধান অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ মেনে এতে প্রতিবেশী দেশর সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে।অনেকেই মনে করেন দেশ ভাগের যে দ্বি-চারিতা তা সাধারণ জনগণের কোন দোষ নেই। সাধারণ জনগণ ছিল তাঁদের হাতের পুতুল। অখন্ড ভারতের বিভক্ত ” পাকিস্তান -ভারত- বাংলাদেশ – কাশ্মীর” এই মাতৃভূমির ওপর দ্বি-চারিতা আজীবন জিইয়ে রাখারই কৌশল জল্লাদের মত ভূমিকা পালন করেন স্বাধীন ভারতের গভর্নর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। আর সেই বলির পাঁঠা হয়েছিলেন দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জিন্না – জহরলাল নেহরু।১৯৪৩ সালের ২১ শে অক্টোবর সিঙ্গাপুরে অস্থায়ী আজাদ হিন্দ্ সরকার গঠিত হয়েছিল |

২৩ শে অক্টোবর মাঝ রাতে এই সরকার ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল | কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আজাদ হিন্দ্ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল জাপান , বার্মা, ক্রোশিয়া,জার্মানি, ফিলিপিন্স,নানকিং,মাঞ্চুকুয়ো ইতালি ও শ্যাম — এই মোট নয়টি দেশের সরকার | তখন আজাদ হিন্দ্ সরকারের প্রেসিডেন্টরূপে নেতাজী ঘোষণা করেছিলেন |Netaji Declar “The Provisional Govenment is entitled to, and hereby claims the allegiance of every Indian. It guarantees religious liberty, as well as equal rights & equal opportunities to all its citizens.”এতে বলা হয়েছিল যে আজাদ হিন্দ সরকার শুধু প্রবাসী ভারতীয়দের সরকার নয় | তা সমগ্র ভারতবাসীর সরকার| তাই এই সরকার প্রত্যেক ভারতীয়ের আনুগত্য লাভের অধিকারী | এই সরকার তার নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা,সমান অধিকার ও সমান সুযোগ লাভের অঙ্গিকার করছে |সূর্যালোকে আসেনি ভারতের স্বাধীনতা| আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম মধ্যরাতের অন্ধকারে | ঘড়িতে তখন রাত বারোটা | অখন্ড ভারতের বারোটা বাজিয়ে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছিল | মাঝরাতে দু’টুকরো হয়ে গেল দেশ | কিন্তু ভারত ভেঙে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়নি | জন্মেছিল দু’টি পৃথক ডোমিনিয়ন | ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসের ঠিক মাঝামাঝি ১৪ – ১৫ ই আগষ্ট বাস্তবে কী ঘটেছিল তাঁর ছোটো একটা বিবরণ ইংরেজিতে তুলে দিলাম —New Delhi, Aug 15 :- Two new Dominions , India and Pakistan , were born at zero hour today, ushering in political freedom to 400 million people constituting one – fifth of the human race. At a special session of the Indian Constituent Assembly, the House assumed full powers for the administration of the Indian Dominion.সূর্যডোবা সেই রাতে এসেছিল ভারতের বুক চিরে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান নামে আলাদা দুই ডোমিনিয়নের জন্ম | সেইসঙ্গে ক্ষমতার হস্তান্তর |মুক্তিযুদ্ধে দুই প্রধান নায়কই ছিলেন ওই দৃশ্যে অনুপস্থিত | ১. মহাত্মা গান্ধী, যিনি প্রথমে বলেছিলেন যদি দেশভাগ হয় আমার বুকের ওপর দিয়ে হবে কিন্তু তিনি ই প্রথম দেশভাগের চুক্তি তে সাক্ষর করেন। সেই সময় গান্ধীজি র কথাই ছিল শেষ কথা।তিনি অনশনে বসতে পারতেন দেশভাগের বিরোধীতা করে কিন্তু তা বাস্তবে করেন নি। কলকাতার বেলেঘাটায় বস্তি এলাকায় মুখ লুকিয়ে ওই রাতটি কাটিয়েছিলেন | ২. নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ( নেতাজি স্বয়ং থাকলে বোধ হয় এটি হত না )|স্বাধীনতা দেশভাগ একসঙ্গে জড়িয়ে গেল | কিন্তু দেশভাগ ছিল যতটা নিরেট সত্য, স্বাধীনতা ততটা নয় | দেশভাগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল কোটি কোটি মানুষের চোখের জল | রক্তের স্রোত বয়েছিল | জাতির চেয়ে বড় হয়েছিল সম্প্রদায় | যেখানে সম্প্রদায় বিশেষ জেহাদ ছাপিয়ে গিয়েছিল জীতীয় সংগ্রামকে | শুরুতেই গড়ার চেয়ে ভাঙাই পেল মর্যাদা | দেশপ্রেমকে বিদায় জানিয়ে মান্যতা দেওয়া হল ক্ষমতার কাড়াকাড়িকে |কে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবেন !সেইরাতে গান্ধিজিও নাকি নিরবে কেঁদেছেন |

পরে স্বীকার করছিলেন ১৫ ই আগষ্ট ছিল তাঁর পরাজয়ের দিন | গ্লানিভারে নুয়ে পড়েছিলেন তিনি | গান্ধিজি বলেন –“জওহরলাল, সর্দার প্যাটেল , মৌলানা আজাদ সবাই তাঁর দূরের মানুষ| এরা এতকাল আমাকে মই হিসেবে ব্যাবহার করেছে | কাজ ফুরোলে ছুঁড়ে ফেলেও দিয়েছে | গান্ধিজি পরে স্বীকার করেন যে “যদি সুভাষ ফিরত তবে দেশভাগ হত না |”স্বাধীনতা ও দেশভাগ একই সময়ে ব্রিটিশ আইনের আওতায় | আইনের নাম The Indian Independence Act, 1947 …কিন্তুু ৫নং ধারায় এসে থলির বেড়াল বেড়িয়ে পড়েছিল|For each of the new Dominions, there shall be a Governor General who shall be appointed by His Majesty and shall represent His Majesty for the purposes of the Govenment of the Dominion.ব্রিটিশ যে ভারত থেকে বিদায় নেবে সুভাষচন্দ্র তা জানতেন | যাবার আগে তারা যে অখন্ড ভারতকে করে দিয়ে যাবে তা তিনি যুদ্ধ শুরু হবার আগেই বুঝেছিলেন | কংগ্রেস সভাপতির ভাষণে সে বিষয়ে তিনি জনসাধারণ ও শিক্ষামন্ডলীকে হুঁশিয়ার করেও দিয়েছিলেন | তারপর যখন তিনি দেশের বাইরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় স্বাধীনতার যুদ্ধ চলা কালীন তখন বেতার ভাষণে গান্ধী, নেহেরু,প্যাটেল প্রমুখ নেতৃমন্ডলীর কাছে বারবার তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন, মাতৃভূমিকে দ্বিখন্ডিত হতে দেবেন না | কেউ শোনেনি তাঁর কথা | তাই আজ সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনীতি যেন জাতির অন্ধ বিবেচিত নির্বাচিত প্রার্থী কূটনীতিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে দুর্নীতির দিকে ক্রমশ অগ্রসর হয়েছে | অর্থনীতি সাম্যতা কমে দিনে দিনে বেকারত্বের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে | স্বাধীনতার নতুন সূর্য কখনও দেখতে চায়নি ক্ষুধার্ত অসহায় শিশুর কান্না আর বেকারত্বের অবহেলিত নিরব নোনাজল !