আপডেট প্রতিদিন, বেবি চক্রবর্ত্তী :- সময়টা ছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি সেই সময় ব্রিটেন, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডে তখন কলকারখানা গুলো গড়ে ওঠার ফলে শিল্পায়ন ক্রমবর্ধমান হলেও মানুষদের তেমন আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না, তখন বিদ্যুৎ, প্রযুক্তি, এলার্ম ঘড়িও এতটা সহজলভ্য হয়নি। তখন প্রতিটা কলকারখানায় সময়ানুবর্তিতাও খুব কঠিন ছিল। কলকারখানা গুলিতে বেশি শ্রমিকের পাশাপাশি আরো বেশি কাজের সময়ের প্রয়োজন ছিল। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরেও শ্রমিকদের বেতন ছিল ন্যূনতম। শ্রমিকদের কাজে আসতে দেরি হলে তাঁদের বেতন কাটা যেত অথবা কোন সময় চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ও ছিল।
সারাদিনের খাটুনির পর কারখানার শ্রমিকরা কম্বলের তলায় গভীর নিদ্রামগ্ন অবস্থায় থাকার ফলে সকালে কর্মীদের ঘুম থেকে উঠতে অনেক সময় দেরি হয়ে যেত। শ্রমিকরা কারখানায় তাড়াতাড়ি যেতে পারতেন না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল এলার্ম ঘড়ির। কিন্তু তখনকার বাজার মূল্য অনুযায়ী এটা সহজলভ্য ছিল না। আসলে তখন এলার্মের ব্যবস্থা বা মোবাইল ফোনের ব্যবস্থা ছিলোনা। তখন যান্ত্রিক এলার্মের ব্যবস্থা না থাকলেও ছিল ‘জীবন্ত এলার্ম’। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে ‘জীবন্ত এলার্ম’ আবার কি? এই জীবন্ত এলার্ম ই হলো আদতে ‘মানুষ’। যাঁদের দায়িত্ব ছিল ভোর বেলায় মানুষদের ঘুম থেকে ডেকে দেওয়া।
শিল্প বিপ্লবের সময়ে এই ঘুম ভাঙানিয়া পেশার জন্ম হয়। সাধারণত কল কারখানার শ্রমিকরাই খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার জন্য ঘুম ভাঙানিয়াদর ভাড়া করতেন। এরাই পরিচিত হন ‘নকার আপার্স’ নামে। ওই দেখা যায় ভোরের আবছা আলো – সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সবাই তখন অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। এরা তখন শান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে কখনো দরজায় ঠক ঠক শব্দ, কখনো টোকা মেরে, আবার কখনো সাইরেন বাজিয়ে ঘুম ভাঙানোর কাজ করতেন। ঘুমে ব্যাঘাত করার জন্য অনেকে তো আবার চোখ কচলাতে কচলাতে জানালা দিয়ে তাদের গালিগালাজও করতেন। কিন্তু সেই সব তো আর কানে নেওয়া যায় না? এটাই তাদের কাজ, তাদের পেশা। প্রথমদিকে এই নকার আপার্সরা কখনো দরজায় ধাক্কা মেরে আবার কখনো তারা দরজার সামনে এসে বলতেন, ” উঠে পড়ো সাহেব, ভোর হয়ে গেছে….” এইভাবে ডাকার ফলে অন্যান্য লোকেদের অসময় ঘুম ভেঙ্গে যেত। এই জন্য এই নকার আপার্সদের টাকা কাটা যেত। এক জন নকার আপার্স কর্মীকে গড়ে ৩৫ থেকে ১০০ জনের ঘুম ভাঙাতে হত। টাকা কাটা যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই সমস্ত নকার আপার্সরা একটা পন্থা অবলম্বন করতেন। এরা ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগানোর জন্য হাতিয়ার হিসাবে ‘স্নাফার আউটার’ ব্যবহার করতেন। এই সরঞ্জামটি গ্যাসের বাতি নেভানোর জন্য ব্যবহার করা হতো যা সন্ধ্যার সময় জ্বালানো হতো আর ভোরবেলা নিভাতে হত। সাধারণত খুব অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বয়স্ক পুরুষ, কখনো পুলিশ কনস্টেবল এবং গর্ভবতী মহিলারা এই পেশায় নিযুক্ত হতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনও ভোর বেলায় শ্রমিকদের ঘুম ভাঙ্গাতে রাস্তায় দেখা যেত ঘুম ভাঙানিয়াদের। এদের কারো হাতে লম্বা পাইপ বা লাঠি আবার কারোর হাতে হাতুড়ি ও থাকতো। লম্বা লাঠি অথবা হাতুড়ি ছাড়াও সরু ফাঁপা লাঠির ভেতর মোটরের দানা ভরে শ্রমিকদের শোবার ঘরের জানালায় ছুঁড়ে মেরে ঘুম ভাঙাতেন অথবা লম্বা লাঠি দিয়ে ঘুমন্ত মানুষের ঘরের জানালায় টোকা মেরে ঘুম ভাঙাতেন এই নকার আপার্সরা। কিন্তু আমাদের খুব জানতে ইচ্ছা করে এই বিচিত্র পেশার পেশাজীবী যাঁদের ওপর দায়িত্ব ছিল অন্য মানুষদের ঘুম থেকে ওঠানো তাঁরা কিভাবে এত ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন?
এদের ঘুম বা বিশ্রাম নেবার পদ্ধতি ছিল একটু অন্যরকম। শ্রমিকদের ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য প্রায় সারারাত না ঘুমিয়ে কাটাতেন এই সমস্ত নকার আপার্সরা। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই এরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তেন শ্রমিকদের ঘুম ভাঙ্গানোর উদ্দেশ্যে। ঘুম ভাঙ্গানোর কাজ শেষ হয়ে গেলে নিজের বাড়ি ফিরে যেতেন তাঁরা। বাড়ি ফিরে নিজেদের কাজ শেষ করে বিকেল অথবা সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়ে নিতেন নকার আপার্সরা। কিন্তু সন্ধ্যার পর আর তাঁরা ঘুমোতেন না কারণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের ঘুম না ভাঙলে তাঁরা শ্রমিকদেরও ঘুম ভাঙাতে পারবেন না। সেই ভয়ে সারারাত জেগে বসে থাকতেন নকার আপার্সরা।
সারারাত না ঘুমিয়ে প্রচন্ড ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে সামান্য অর্থের বিনিময়ে কারখানার কর্মচারীদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেবার পেশায় যেসব নকার আপার্সরা নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের কপালে জুটতো গালিগালাজ। এমনকি তাদের গায়ে জল ও ঢেলে দেওয়া হতো। সামান্য কৃতজ্ঞতাও নিয়োগ কর্তাদের থেকে তাঁরা পেতেননা।আজকের যুগে দাঁড়িয়ে যখন আমরা সময়কে হাতের মুঠোয় করে নিয়েছি তখন আমরা ভুলে যেতে বসেছি সেই সময়ের কথা যখন ঘুম থেকে ওঠার জন্য এলার্ম হিসেবে ব্যবহার করতে হতো মানুষকে। তাই কালের স্রোতে এই পেশা যাতে হারিয়ে না যায় সেই কারণে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত উত্তর ইংল্যান্ডের কিছু শহরে নিয়োগ করা হয়েছিল নকার আপার্সদের। কিন্তু সময়ের চাকা যত গড়িয়েছে আমরা যতই আধুনিক মনস্ক হয়ে উঠেছি ততই আমরা ভুলে যেতে বসেছি সেইসব নকার আপার্সদের কথা। যারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর,রাতের পর রাত জেগে নিরবে কাজ করে গেছেন। কালের গর্ভে আজ তারা হারিয়ে গেছে। যেমন আমরা ভুলে গেছি ঘুম পাড়ানি সেই গানের কথা ঠিক তেমনি আমরা ভুলে গেছি ঘুম ভাঙানিয়াদের কথা।
টাইম মেশিনকে পিছনের দিকে ঘোরালে ভোরের রক্তিম আভায় কান পাতলে পাখির কলরবের সাথে হয়তো এখনও শোনা যাবে জীবন্ত এলার্ম ঘুম ভাঙানিয়াদের সেই কথা ” উঠে পড়ো সাহেব, ভোর হয়ে গেছে….” ।