জাগতিক অনন্তশক্তি

আপডেট প্রতিদিন, বেবি চক্রবর্ত্তী:- মনই মহাজগৎ। আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী স্মাইলি ব্ল্যান্টন বলেন যে “মনের গহন গভীর স্তরে শক্তি, দৃঢ়তা ও সাহসিকতার যে উৎস আছে তা আমারা কল্পনাও করতে পারি না। প্রত্যেকেই তার মনের ঐ স্তর অনুযায়ী দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় এবং সেই মতো সহায়তাও পেয়ে থাকে। আমাদের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে অফুরন্ত সম্পদ আছে তবে আমরা যদি সেটা খুঁজে বার করে তার সদ্ব্যবহার করতে পারি তবেই সার্থকতা।” এই সম্পদ কিন্তু মানসিক শক্তি।

যেখানে মানবিক মনের গভীরতা সীমিত সেখানেই সাধনাই একমাত্র পথ উপলব্ধির। তোমার মধ্যেই জাগতিক সেই অনন্তশক্তি নিহিত । যদি আমরা জীবন ও অস্তিত্বের অর্থ খুঁজতে যাই তাহলে আকাশের গ্রহনক্ষত্র, রাশিপুঞ্জ ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জানাই যথেষ্ট হবে না —– সেটা সম্ভব একমাত্র মন আচরণ করে, এর কার্যসম্পাদনের বিধিনিয়ম এর মৌলিক প্রকৃতি ও ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল হতে হবে। কথায় আছে বিন্দুতেই সিন্দু। যদি আমরা বিশাল মহাকাশ নক্ষত্রমন্ডলীর প্রকৃতি অনুধাবন করি তবে দেখতে পাব মানুষ যেন গভীর সমুদ্রের মাঝে এক বারিবিন্দু মাত্র। ঠিক দূর থেকে মনে হবে মানুষ একটি ধূলিকণা। কিন্তু বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করেছে যে এই এক একটি বিন্দুর মধ্যেও অসংখ্য সিন্ধু লুকিয়ে আছে। মানব শরীরের আকার, গঠন, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ , প্রত্যেকটি কোষকলার জটিল ক্রিয়াকলাপ।

স্বামী বিবেকানন্দের মতে সাধনার প্রধান উদ্দেশ্যই হল ভয়শূন্য হওয়া।
উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে যে ব্রহ্মকে জানতে হবে তবেই মোক্ষলাভ হবে। ব্রহ্মকে জানার অর্থ হল, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা। বৃহদারণ্যক উপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য নিজের স্ত্রী মৈত্রেয়ীর প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন – ‘আত্মনস্তু কামায় সর্বং প্রিয়ং ভবতি’ অর্থাৎ সংসারে যা কিছু আমাদের প্রিয় তা আত্মার জন্যই। সেই আত্মাকে দর্শন করতে হবে, আত্মার কথা শ্রবণ করতে হবে, মনন করতে হবে, ধ্যান করতে হবে। এই শ্রবণ, মনন ও নিধিধ্যাসনের (ধ্যান) দ্বারাই
আত্মাকে বা ব্রহ্মকে জানা যায়। যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হন – ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি।

উপনিষদে”হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তত্ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে॥১৫

অন্বয়: পূষন্ (হে সূর্য, জগতের ধারক); হিরণ্ময়েন পাত্রেণ (জ্যোতির্ময় পাত্রের দ্বারা); সত্যস্য মুখম্ (সত্যের মুখ); অপিহিতম্ (আবৃত); ত্বং তৎ (তুমি তা); অপাবৃণু (দয়া করে সরিয়ে দাও); সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে (যাতে সত্যের অনুসন্ধানী আমি তা দেখতে পাই)।

সরলার্থ: সত্যের মুখ উজ্জ্বল সোনার পাত্রের দ্বারা আবৃত। জীবন ও জগতের ধারক হে সূর্য, তুমি সেই আবরণটি দয়া করে সরিয়ে দাও যাতে সত্যজিজ্ঞাসু আমি, সত্যকে দর্শন করতে পারি।

ব্যাখ্যা: সূর্যকে এখানে ব্যক্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। সূর্য সবকিছুর ধারক। তিনি জীবন এবং যাবতীয় বস্তুর উৎস। সূর্য নিজে উজ্জ্বল এবং সূর্যের কিরণেই অন্য সব বস্তু আলোকিত হয়। তাঁর উজ্জ্বলতা আমাদের চোখে ধাঁধা লাগায়। উপনিষদ বলেছেন, সূর্যের অন্তরালে সত্য আছে এবং সেই সত্যই ব্রহ্ম। আমরা সবাই সেই সত্যকে, ব্রহ্মকে খুঁজে চলেছি। কিন্তু তাঁকে দেখতে পাই না। কারণ সূর্যের আলো আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সূর্য যেন একটি উজ্জ্বল সোনার পাত্র, সত্যকে আড়াল করে আছে। আমরা তাই সূর্যের কাছে প্রার্থনা করি তিনি সেই আড়ালটি সরিয়ে দিন, আমরা যাতে ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার লাভ করতে পারি অর্থাৎ সত্যকে উপলব্ধি করতে পারি।

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সব বস্তু এভাবেই যেন এক সোনার পাত্রের দ্বারা ঢাকা। আর সেই জন্যই আমরা সেদিকে আকৃষ্ট হই। কিন্তু এই বস্তুসমূহ সত্য নয়, যদিও সত্য বলে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়।সেইরকম সত্যকে দেখার জন্যও জ্ঞানের আলোর প্রয়োজন। সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য দরকার বিবেকজ্ঞান অর্থাৎ বিচারবুদ্ধির। দৃশ্যমান জগৎ সত্য নয়; সত্য নয় এই অর্থে যে, তা সদা পরিবর্তনশীল।

অন্বয়: যস্মিন্ (যখন); আত্মা এব (একমাত্র আত্মা); সর্বাণি (সকল); ভূতানি (ভূত সমূহ); অভূৎ (হয়েছে); তত্র (তখন); বিজানতঃ (যিনি এটা জানেন); একত্বম্ (একরূপে); অনুপশ্যতঃ (দেখেন যিনি); কঃ (কোথায়); মোহঃ (মোহ); কঃ (কোথায়); শোকঃ (শোক)।

সরলার্থ: যখন কোন ব্যক্তি সব কিছুর মধ্যে এক আত্মাকেই দেখেন এবং জানেন যে তিনি নিজেই সব কিছু হয়েছেন, তখন তিনি কোন কিছুকে ঘৃণাও করেন না বা কোন কিছুর প্রতি আসক্তও হন না।

ব্যাখ্যা: সবকিছুর সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করার মধ্য দিয়েই আত্মজ্ঞানের যথার্থ পরীক্ষা হয়। আমি সর্বত্র এবং সর্বভূতে রয়েছি। সেখানে ‘এক’ ভিন্ন ‘দুই’ নেই। সেই ‘এক’ই হল স্বয়ং ‘আমি’। এই একত্বকে উপলব্ধি করাই হল জীবনের পরম লক্ষ্য। ব্যবহারিক জীবনে যে বৈচিত্র আছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু নামরূপের বিভিন্নতার জন্যই এই বৈচিত্র। আর এই নামরূপ আমাদের মনেরই কল্পনা মাত্র। এতে আমার কোন পরিবর্তন হয় না। আমি সেই অপরিবর্তিত এক সত্তামাত্র।

যখন আমরা এই একত্বকে উপলব্ধি করতে পারব, তখন আমাদের আসক্তি, ঘৃণা, বা দুঃখ বলে কিছু থাকবে না। দ্বৈত বোধ আসে অজ্ঞানতা থেকে। আত্মজ্ঞান লাভে অর্থাৎ অদ্বৈতের উপলব্ধিতে এই অজ্ঞানতা সমূলে বিনষ্ট হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *