আপডেট প্রতিদিন, কলকাতা, বেবি চক্রবর্ত্তীঃ-কলকাতা তখন ঠিক কলকাতা ছিলনা। সেটা ছিল জলে জঙ্গলে ভরা একটা ভূখণ্ড। যার যত্রতত্র ছিল আগাছা আর খাল-বিল। সেই সাথে ছিল অসহ্য আবহাওয়া। এরই মধ্যে ইংরেজরা কলকাতায় উপস্থিত হয়েছিল। ১৬৯০ সালের ২৪শে আগস্ট তারিখে ‘সুতানটি’, ‘গোবিন্দপুর’ আর ‘কলকাতা’কে প্রায় জলের দরে কিনে নিয়ে ইংরেজরা এখানে ওখানে নিজেদের সুবিধে মত কাদামাটি আর বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি ঘর তুলতে শুরু করেছিলেন। একই সঙ্গে তাঁরা এটাও উপলব্ধি করেছিলেন যে কলকাতায় নিজেদের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা ঠিকমত না করতে পারলে, তাঁদের নগর গড়ে তোলার স্বপ্ন কোন দিনই বাস্তবে পরিণত হবে না। তাই ১৬৯০ সালেই ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ একটা আদেশ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল যে, কোম্পানির দখলী আর পতিত জমি আর জঙ্গল সাফ করে যে কেউ তাঁর ইচ্ছেমত ঘর বাড়ি তৈরী করতে পারবেন।
ইংরেজরা কিন্তু এটা ভালোভাবেই জানতেন যে সেসব কাজ করতে গেলে অনেক টাকার দরকার। তাই তাঁরা ১৭০৪ সালে ঠিক করেছিলেন যে দেশীয় লোকদের কাছ থেকে জরিমানা বাবদ আদায় করা টাকা দিয়ে কলকাতা শহরের ভেতরে আর আশ পাশের খানা-ডোবা ভরাট করে নর্দমা তৈরি করবেন। সেটাই ছিল কলকাতার পৌর সংস্থার আদি কথা।
কোন লোক যাতে তাঁর খুশিমত যেখানে সেখানে বাড়ি তৈরি বা পুকুর কাটতে না পারেন তার জন্য ১৭০৭ সালে পুরানো কেল্লার দরজায় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল।
১৭১০ সালে ‘ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের’ ভেতরে আর আশপাশের গাছপালা কাটাবার আর জল নিকাশের ব্যবস্থার জন্যে আদেশ প্রচার করা হয়েছিল।
কলকাতায় ‘পৌর সংস্থা’ বা ‘মিউনিসিপ্যালিটি’ ধাঁচের সংস্থা গড়ে উঠেছিল ১৭২০ সালে। তখন কলকাতা শহরের স্বাস্থ্যের উন্নতিই ছিল মিউনিসিপ্যালিটির প্রধান লক্ষ্য। আদি কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির প্রধান ছিলেন ‘মেয়র’। তাঁকে সাহায্য করবার জন্যে থাকতেন ৯ জন ‘অলডার ম্যান’। ‘হলওয়েল’ ছিলেন সেই সময়ের কলকাতা কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট। ১৭৪৯ সালে কলকাতায় নর্দমা কাটানোর জন্যে কিছু টাকা মঞ্জুর করা হয়েছিল। ১৭৫৩ সালে কলকাতার চারদিকে নর্দমার ব্যবস্থার কথা বিভিন্ন প্রাচীন নথি থেকে জানা যায়। ১৭৫৫ সালে ‘ট্যাঙ্কস্কোয়ার’ বা ‘লাল দীঘি’তে ঘোড়া স্নান করানো নিষিদ্ধ করে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। ১৭৫৫-৫৬ সালে গোটা কলকাতায় পাকা বাড়ি ছিল ৪৯৮টা। কাঁচা বাড়ির সংখ্যা ছিল ১৪,৪৫০। ১৭৫৭ সালে ‘কুমোরটুলি’ অঞ্চলে এক কাঠা জমির দাম ছিল ১১ টাকা।
‘লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের’ আমলেও কলকাতায় এখনকার মত মিউনিসিপ্যালিটির কোন অস্তিত্ব ছিল না। সেই সময়ে শহরের জঞ্জাল সাফ করার বিভাগটি পুলিশ বিভাগের অধীন ছিল। নেটিভ টাউনে প্রত্যেক থানায় দু’খানা করে ময়লা ফেলার গাড়ি থাকত। তখন ময়লা সাফ করার বিভাগের নাম ছিল ‘স্ক্যাভেঞ্জার অফিস’।
১৮২০ সাল থেকে কলকাতা শহরে পাকা রাস্তা তৈরি করা শুরু হয়েছিল। সেই কাজের জন্য বার্ষিক পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছিল।
১৭০৯ সালে কলকাতার সাহেবরা বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলে আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়া একহাজার টাকা অনুদান দিয়ে ‘সেইন্ট অ্যান গীর্জা’ গড়ে তুলেছিলেন। বর্তমান ‘রাইটার্স বিল্ডিংসের’ পশ্চিম কোণে সেই গীর্জা ছিল। ১৭০৯ সালের ৫ই জুন তারিখে লণ্ডন থেকে বিশপের প্রতিনিধি কলকাতায় এসেছিলেন। এরপরে কলকাতার সেইণ্ট অ্যান গীর্জা প্রভু যীশুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছিল। সেই প্রথম কলকাতায় কোন খ্রীষ্টান ভজনালয় তৈরি হয়েছিল। কোম্পানি ওই গীর্জার জন্য জমি দান করেছিল। সেইন্ট অ্যান গীর্জাকে ফোর্ট উইলিয়ম গীর্জাও বলা হত। এর আগে পুরনো কেল্লার মধ্যে অবশ্য একটা উপাসনালয় ছিল। কিন্তু পুরানো কলকাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরী আর উৎসর্গ করা গীর্জা ছিল সেইণ্ট অ্যান গীর্জা।


১৭৩৭ সালে কলকাতায় যে প্রলয়ংকর ঝড় হয়েছিল তাতে সেইণ্ট অ্যান গীর্জার চূড়া সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার কলকাতা অভিযানের সময় ওই গীর্জাটি একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর ‘মুর্গীহাটা’র পর্তুগীজদের গীর্জাটিকে ইংরেজরা উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। ১৭৬০ সালে পুরনো কেল্লার মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল ‘সেইণ্ট জন গীর্জা’। তখন পর্তুগীজদের গীর্জাটিকে ইংরেজরা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত সেটিই ছিল ‘প্রেসিডেন্সি গীর্জা’। ‘মিডলটন’, ‘হিবার’, ‘জেমস্’, ‘টার্নার’, আর ‘উইলসন’ ওই গীর্জাতেই বিশপের পদলাভ করেছিলেন।
১৭৮৭ সালে কলকাতার পুরনো বারুদখানা আর পুরনো গোরস্থানের উপরে ‘সেইণ্ট জন গীর্জা’ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ঐ বছরের ২৪শে জুন তারিখে ‘লর্ড কর্ণওয়ালিস’ সেই গীর্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ১৭৮৩ সালে ওই গীর্জার জন্য একটা কমিটি তৈরি হয়েছিল। সেই কমিটির প্রথম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’। সেই দিনই জনসাধারণের কাছ থেকে সংগ্রহ করে ৩৫,৯৫০ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। লটারি থেকে পাওয়া গিয়েছিল ২৫,৫৯২ টাকা। বাকি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল চাঁদা তুলে। ওই গীর্জা তৈরির জন্য মোট খরচ হয়েছিল এক লক্ষ সত্তর হাজার টাকা। ‘মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব’ ওই গীর্জার জন্য জমি দান করেছিলেন। গীর্জার নক্সা তৈরি করেছিলেন ‘লেফটেন্যান্ট জেমস্ অ্যাগ’। ‘চুনার’ আর ‘গৌড়’ থেকে পাথর আনিয়ে ওই গীর্জায় লাগানো হয়েছিল। সেই জন্য তখন লোকে সেটাকে ‘পাথুরে গীর্জা’ও বলত। সেকালের স্বনামধন্য চিত্রকর ‘জোফানি’ সেইন্ট জন গীর্জার বেদীর জন্য ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। সেই ছবিটির নাম ছিল ‘লাস্ট সাপার’। আজও সেইন্ট জন গীর্জার ভেতরের সমাধিস্থলে ‘জোব চার্নক’, ‘ডাক্তার উইলিয়ম হ্যামিলটন’, ‘ভাইস অ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসন’ প্রমুখের সমাধি রয়েছে।
অতীতের একটা প্রবাদ বাক্য ছিল যে “বঙ্গে এলে কপালও সঙ্গে আসে”। তাই কলকাতার মাটির নীচে প্রথমাবধি অনেক সাহেবকেই শেষ শয্যা নিতে হয়েছিল। আর সেটা হয়েছিল একেবারে কলকাতার আদি পর্ব থেকে। পুরানো কলকাতার প্রথম নিদর্শন হিসেবে তাই কবরখানাকে গণ্য করা যেতে পারে।
সেইন্ট জন গীর্জার প্রাঙ্গণে জোব চার্নকের সমাধিটি সম্বন্ধে ‘হাইড’ সাহেব বলেছিলেন, “সম্ভবতঃ এইটিই কলকাতার প্রাচীনতম পাকা গাঁথুনি।” অবশ্য ‘আর্মেনিয়ান গীর্জা’র প্রাঙ্গণে ‘শ্রীমতী আর সুকিয়াসের’ সমাধি ফলকে ১৬৩০ সালের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। জোব চার্নকের সমাধিতে ১৬৯২-৯৩ সাল খোদিত রয়েছে। চার্নকের ‘কন্যা মেরি আয়াব’ ও ‘ক্যাথারিনের’ সমাধি ফলকে ১৬৯৬-৯৭ আর ১৭০০-০১ সালের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। আর্মেনিয়ান গীর্জার শ্রীমতী সুকিয়াসের সমাধির কথা বাদ দিলে কলকাতায় সাহেবদের সমাধি হিসেবে সেইন্ট জন গীর্জা প্রাঙ্গণের সমাধিস্থলকেই কলকাতার সাহেবদের প্রাচীনতম সমাধিক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হয়। সেইণ্ট জন গীর্জার সমাধি ক্ষেত্রে জোব চার্নক ছাড়াও আদি কলকাতার ডাকসাইটে ডাক্তার ‘উইলিয়াম হ্যামিল্টনের’ সমাধিটি রয়েছে। তাতে ১৭১৭ সাল খোদিত রয়েছে। সার্জন হ্যামিল্টন শুধুমাত্র চিকিৎসকই ছিলেন না, তিনি রাজনৈতিক ডাক্তারীটাও ভাল মত বুঝতেন। দিল্লির দরবারে তাঁর ডাক্তারীর সুনামের সুযোগ নিয়ে তিনি বৃটিশ বণিকের ‘মানদণ্ড’কে ‘রাজদণ্ডে’ পরিণত করার কাজটাও হাসিল করে নিয়েছিলেন।
হ্যামিল্টন ছাড়া সেখানে পলাশীযুদ্ধের অন্যতম নায়ক ‘অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের’ সমাধিও রয়েছে। ওয়াটসন পুরানো কলকাতার এক মহামারীতে মারা গিয়েছিলেন। অতীতে সেইন্ট জন গীর্জার জমির ওপরেই ছিল কলকাতার ইংরেজদের আদি গোরস্থান। সেটার পূর্ব দিকে ছিল বারুদখানা, মাঝখানে ছিল একটা গভীর খাল। পরে গীর্জা তৈরীর সময় কবরখানার ভাঙাচোরা সমাধিস্তম্ভগুলো ভেঙে ফেলে পাথরের ফলকগুলো তুলে এনে গীর্জার পাশে সমাধিস্থলের প্রাঙ্গনে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *