আপডেট প্রতিদিন, বেবি চক্রবর্ত্তীঃ- ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল বিলিতি জাহাজ কোম্পানি ফ্লোটিলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুলনা-বরিশাল জলপথে ফেরি চালাবেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বুঝতে পারেননি, ওটাই হয়ে উঠবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিন। জাহাজের উদ্বোধনের কোনও কর্মকাণ্ডে স্ত্রী কাদম্বরীকে জড়াননি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বলেছেন, একেবারে উদ্বোধনের দিন জাহাজে নিয়ে গিয়ে চমকে দেবেন। কাদম্বরী প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিশু তাঁতিনিকে ডেকে নতুন একটি কমলারঙা স্বর্ণচরী শাড়ি বেছেছেন উদ্বোধনে পরার জন্য, গয়না বেছে বেছে আয়নার সামনে পরে দেখছেন। শুধু জ্যোতিই তাঁকে চমক দেবেন তা হয় না, কাদম্বরীও চমকে দেবেন জ্যোতিকে।
জীবনের সেরা সাজ সাজবেন তিনি। রূপের উজ্জ্বলতা নিয়ে যখন জাহাজের ডেকে গিয়ে দাঁড়াবেন, লোকের চোখ তাঁকেই ঘুরেফিরে দেখবে। শাড়ি-গয়না নাড়াচাড়া করেন, আর অপেক্ষা করতে থাকেন ১৯-এর বিকালের জন্য। জাহাজে তখন শেষমুহুর্তের চাপ। একদিকে প্রবল কর্মযজ্ঞ আর অন্যদিকে অনন্ত প্রতীক্ষা।
১৯ এপ্রিল বিকালের আগেই কমলা রঙের স্বর্ণচরীতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন হেকেটি ঠাকরুন, এবার সবার মাথা ঘোরানোর পালা। উদ্বেগে ঘরে-বাইরে করছেন, ভাবছেন কীভাবে জ্যোতির মুখোমুখি হবেন! কিন্তু জ্যোতি কিছুতেই সময় পাচ্ছেন না জাহাজ ছেড়ে বেরতে। শেষে আদরের ছোটো ভাই রবিকে বললেন তাঁর নতুন বউঠানকে নিয়ে আসতে। রবি জানেন তাঁর নতুন বউঠান কতখানি অভিমানিনী, তিনি সাহস পান না, বলেন, না জ্যোতিদাদা, আজ তোমাকেই যেতে হবে। আজ আমি তাঁকে সামলাতে পারব না। কিন্তু জ্যোতি বেরতে গেলেই কেউ না কেউ পিছু ডাকেন, থেমে যেতে হয়। কাদম্বরী অপেক্ষা করেন। বিকাল পেরিয়ে সন্ধে হয়, সন্ধে পেরিয়ে রাত। ছাদ থেকে কে যেন বলে ওঠে, কই লো নতুনবউ, তোর বর নিতে এল না?
অভিমানে এক এক করে সব গয়না খুলে ফেললেন কাদম্বরী। শাড়ি খুলে মেঝেতে ফেলে দিলেন। সাটিনের পেটিকোট আর রেশমি জ্যাকেট পরে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। কী অপমান!
অনেক রাতে উঠে হাতির দাঁতের কৌটো খুলে বিশু তাঁতিনির কাছ থেকে চেয়ে রাখা আফিমের সবটা মুখের মধ্যে ঢেলে দিলেন কাদম্বরী। তারপর জল খেয়ে মাতালের মতো টলতে টলতে শুয়ে পড়লেন মেঝেতে। সকালে তাঁকে মৃতপ্রায় অবস্থায় আবিষ্কার করার পরে শুরু হল যমে মানুষে টানাটানি। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন কাদম্বরী, তাঁর পঁচিশ বছরের স্বর্গীয় সৌন্দর্যরাশি যেন ক্রমশ বিষাক্ত আইভিলতার চেহারা নিচ্ছে।
রবি টানা দু’দিন তাঁর শয্যার পাশে বসে রইলেন অপরাধী হৃদয়ে। জ্যোতির অবস্থা উদ্ভ্রান্তের মতো। সত্যি সত্যি কাদম্বরী যে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে, এটা তাঁর ভাবা উচিত ছিল! সেরেস্তার কাজ বন্ধ। দুই বিখ্যাত ডাক্তার নীলমাধব হালদার ও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করেও কিছু করা গেল না।২১ এপ্রিল ভোরে কাদম্বরী মারা গেলেন।তাঁর শেষযাত্রায় সঙ্গ নিলেন রবি, সোমেন্দ্র, দ্বিপেন্দ্র ও অরুণেন্দ্র। সারাটা পথ রবি একটিও কথা বললেন না। ফিরে এসেও না। চব্বিশ বছরের জীবনে মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনও দেখেননি তিনি। তাঁর সবচেয়ে আপন মানুষটিই অভিমান করে চলে গেলেন, কত কী সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল, কত কথা অকথিত রইল। আর-একটু মনোযোগ দিলে এই বিপত্তি ঘটত না, এই আপশোস কখনও যাবে না।
মহর্ষির নির্দেশে পুড়িয়ে ফেলা হল কাদম্বরীর সমস্ত হাতের লেখা। খবরের কাগজে মোটারকম ঘুষ দিয়ে খবর বন্ধ করা হল। এইভাবেই ঠাকুরবাড়ির সুন্দরীতমা, বিষণ্ণতমা নারীটির মৃত্যু ঢাকা পড়ে গেল অনন্ত রহস্যের মোড়কে।
কিন্তু রবির হৃদয় থেকে তাঁকে উপড়ে ফেলতে পারলেন না কেউই। কাদম্বরীর প্রথমবারের আত্মহননের চেষ্টার পরে ‘তারকার আত্মহত্যা’য় রবি লিখেছিলেন, “যদি কেহ শুধাইত/আমি জানি কী যে সে কহিত/ যতদিন বেঁচে ছিল/ আমি জানি কী তারে দহিত।”