আপডেট প্রতিদিন, বেবি চক্রবর্ত্তীঃ- জায়গাটার নাম সুলেখা মোড়। আর পাঁচটা ব্যস্ত মোড়ের থেকে এর আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই কিন্তু এই এলাকার পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাস। উত্থান, পতন, সাফল্য, ব্যর্থতার কাহিনি দিয়ে বোনা একটি নাম যা দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গজীবনের সাথে জুড়ে রয়েছে। এই নাম আজ এক ব্র্যান্ড!
পুর্ববঙ্গের রাজশাহী শহরের মৈত্র বাড়ি। পরিবারের কর্তা অম্বিকা চরণ স্বাধীনতা সংগ্রামী, গিন্নি সত্যবতী মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী। সেই বাড়ির ছেলে শঙ্করাচার্য ও ননীগোপাল স্বাভাবিক ভাবেই জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এস.সি পড়তেন ননীগোপাল আর পরীক্ষার ঠিক আগেই বিদেশী পন্যের বিরুদ্ধে পিকেটিং করার অপরাধে ঠাঁই হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। জেলে বসেই ফাইনাল পরীক্ষা দেন কিন্তু বাঙালের গোঁ, বিদেশী কালিতে না লিখে উত্তর লিখলেন পেন্সিলে। অল্পের জন্য ফার্স্ট হতে পারেননি।
জেল থেকে ছাড়া পাবার পর সোদপুরে সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের আশ্রমে গান্ধীজির সাথে দেখা করতে যান। উনি ননীগোপালকে নিজের বিলিতি কলম দেখিয়ে আক্ষেপ করেন, তোমরা শিক্ষিত ছেলে এরকমটা বানাতে পারোনা ?
আসলে সেই সময় মহাত্মা গান্ধী শিক্ষিত সমস্ত ভারতবাসীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ার যাতে দেশের যুবসমাজ স্বনির্ভর হতে পারে, নেপথ্যে থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে স্বাধীনতা আন্দোলনকে। গান্ধীজী তাকে কালির ব্যবসা শুরু করার পরামর্শ দেন।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত। তিনি তাঁর সহকারী তথা বেঙ্গল কেমিক্যালসের চীফ কেমিস্ট সতীশ চন্দ্র সামন্ত কে এব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলেন। সামন্ত মশাই ল্যাবরেটরি তে তৈরি তার “কৃষ্ণধারা” কলমের কালি তৈরির ফর্মুলা তুলে দিলেন ননীগোপাল মৈত্রের হাতে। নির্দেশ দিলেন এমন কালি তৈরীর কারখানা গড়ে তুলতে, যা আমদানী করা বিদেশী কালির সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। বর্জন করতে পারে তাকে।
সেই শুরু, ১৯৩৪ সালে পূর্ব বাংলার রাজশাহীতে মৈত্র বাড়ির শঙ্করাচার্য ও ননীগোপাল চালু করলেন কালির কারখানা। বাবা অম্বিকা চরণ তার সারাজীবনের সঞ্চয় তুলে দেন ছেলেদের হাতে।
মূলধন খুবই কম,এমন কি প্রাথমিক যন্ত্রপাতিও কেনা যাচ্ছে না। তবে কালি তৈরী হলো, নাম দেওয়া হলো ‘সুলেখা’ মানে সুন্দর লেখা। ঝর্ণা কলমের জন্য আদর্শ। নিব বারবার ডোবাতে হয়না একবার ভরে নিলেই হলো।
পরিবারের সবাই মিলে ব্যাবসায় নামলেন। বাড়ির মেয়েরা কালি তৈরী করতেন আর পুরুষরা সেগুলো ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। ক্রমে শিক্ষিত বাঙালির ঘরে ঘরে সুলেখার চাহিদা বাড়লো। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর বিজ্ঞাপন লিখে দিলেন, ‘সুলেখা কালি……. এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’
১৯৩৬ সালে কলকাতার মহাত্মা গান্ধী রোডে একটা শোরুম খোলা হলো। ইতিমধ্যে ননীগোপাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ পেলেন। এখান থেকে পাওয়া সবটাকা তিনি এই কোম্পানীর প্রসারে নিয়োগ করলেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার বৌবাজার এলাকায় একটা বড় কারখানা খোলা হলো।
স্বদেশী আন্দোলনের যুগে সুলেখা কালি হয়ে উঠলো একটা হাতিয়ার। এনাদের সাফল্যের কথা শুনে অনেক বাঙ্গালী যুবক উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন। দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল এর চাহিদা। অনেক প্রতিষ্ঠিত বাঙালি শিল্পপতি এই নতুন উদ্যোগের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। ১৯৩৯ সালে কোম্পানী কসবা এলাকায় সরিয়ে আনা হয়। শেষমেশ ১৯৪৬ সালে যাদবপুরে পাকাপাকি ভাবে তৈরি হলো অত্যাধুনিক কারখানা। ওই জায়গার নামই হয়ে যায় সুলেখা মোড়।
অনেক চড়াই উৎরাই,অনেক মামলা মোকদ্দমা অনেক ষড়যন্ত্রের শিকার হয় এই বাঙালি সংস্থা। পরিণতিতে আশির দশকের শেষদিকে বন্ধ হয়ে যায় সুলেখা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর মৈত্র বংশের নতুন প্রজন্মের হাত ধরে ২০০৬ সালে ঘুরে দাঁড়ায় কোম্পানি। কালি দিয়ে শুরু হলেও পরে ফাউন্টেন পেন, ইউজ এন্ড থ্রো বল পেন, ফিনাইল, হ্যান্ড ওয়াস, আঠা এবং solar লন্ঠন তৈরি করে এই সংস্থা। বাংলার বাইরেও বিশাল বাজার তৈরি করেছে এই বাঙালি কোম্পানি। অসম ত্রিপুরা ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশাতেও সুলেখা এখন এক পরিচিত ব্র্যান্ড। রাজ্যের প্রায় তিরিশ হাজার রেশন দোকানে পাওয়া যায় সুলেখার বিভিন্ন প্রোডাক্ট। চালু হয়েছে সুলেখা কাফেটেরিয়া, শুরু হতে চলেছে বেকারি প্রোডাক্ট ………!!!!
কে বলে বাঙালি ব্যাবসা বোঝে না ? বাঙালি একটু কুঁড়ে প্রকৃতির তাই ব্যাবসাগুলো চলে না | সিন্ডিকেট রাজের জন্য অনেক ব্যাবসা বিলুপ্তির পথে আজ পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ নেই, লেবার্ ইউনিয়নের জন্য রিজিন্যাল ইউনিয়ন না থাকায় অনেক ব্যাবসায়ী “রিস্কি” একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় যাতে ব্যাবসা শুরুর আগে ভিত নড়ে যায় ব্যাবসায়ীদের | ভাত ঘুম বাঙালীর অবখ্যয়ের পথে ব্যাবসা| বাবার প্রতিষ্ঠত ব্যাবসা ছেলে করে চাকুরি ব্যাবসাটাকে বিবর্তন করতে পারিনি ১০ টাকারও গুরুত্ব আছে ব্যবসার | বর্তমানে মাসিক আয় শতকরা গুজরাটে আনুমানিক ৩.২৯ % | পশ্চিমবঙ্গে শতকরা ১.৩৯ ওয়েস্টান্ কালচার নিয়েছি ব্রিটিশদের থেকে বিত্তশালীদের কাজ থেকে জমিদার তারাও কিন্তু ব্যাবসায় লগ্নি – বিনিয়োগ চাতুরতা নৈপন্য সমৃদ্ধ ছিল | স্মল্ ইন্ডাস্টির অভাবে ছোট লগ্নির ব্যাবসা ডিজিটাল মারকেটিং সাফল্য বাবসায়ী খুবই কম আছে | অত্যাধিক পরিশ্রম ও ধৈর্য খুব কম থাকায় বাঙালি ব্যাবসা আজ অবলুপ্তির পথে |